শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫১ অপরাহ্ন
রায়হান আহমেদ তপাদার:
প্যারিস চুক্তির অভীষ্ট লক্ষ্য তাপমাত্রাকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত করা এবং কোনোক্রমেই ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বাইরে যেতে না দেওয়া। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে বলেছেন, বিশ্বের তাপমাত্রা এ শতাব্দীর মধ্যে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা সম্ভব হবে না। স্বপ্রণোদিত কার্বন নিঃসরণ কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা পেশ করা হয়েছে, তার পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলেও বিশ্বের তাপমাত্রা এ শতাব্দীর মধ্যে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো বেড়ে যেতে পারে। নিজ উদ্যোগে হওয়ায় তথা আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জবাবদিহি কতটা থাকবে, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। অতীতের ইতিহাস বলে, ১৯৯৭ সালে জাপানে স্বাক্ষরিত কিয়োটো প্রটোকলে শিল্পোন্নত ৩৭টি দেশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর আইনি বাধ্যবাধকতাসহ চুক্তি করেছিল। সে চুক্তিতে অঙ্গীকার পূরণ না হলে জরিমানার বিধানও ছিল। অথচ সেই চুক্তির কার্যকর বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। কপ-২৭ নামে পরিচিত জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন মিসরের শার্ম আল-শেখে শুরু হবে। সম্মেলনটি এমন একসময় হচ্ছে যখন হর্ন অব আফ্রিকা নামে পরিচিত সোমালিয়ায় রেকর্ড পরিমাণ খরা এবং দুর্ভিক্ষের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণের মাত্র ৪ শতাংশ আফ্রিকা থেকে নির্গত হয়। মহাদেশটিতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও সংঘাতময় পরিস্থিতির পাশাপাশি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের গুরুতর প্রভাব ভোগ করছে। নাইরোবিতে প্রকৃতি সংরক্ষণের নীতি ও সরকারি সম্পর্কবিষয়ক আফ্রিকার পরিচালক মুহতারি আমিকু কানো ৩টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিনিয়োগের তালিকা দিয়েছেনপ্রযুক্তিগত স্থানান্তর, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পর্যাপ্ত আর্থিক সংস্থান। এই ৩টি উপাদান ছাড়া আলোচনা অর্থহীন।
গ্লাসগোতে গত বছরের কপ-২৬ সম্মেলনে অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। প্রথম জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় জার্মানির বার্লিনে ১৯৯৫ সালে। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক কপ-২১ সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো প্যারিস চুক্তিতে অনুমোদন দেয়। এটি ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় রাষ্ট্রসমূহের করণীয় নির্ধারণে একটি যুগান্তকারী চুক্তি। এর অধীনে প্রতিটি দেশ কার্বন নিঃসরণের মাত্রা হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অভিযোজন ব্যবস্থা সম্পর্কে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করবে, যা আসলে বৈশ্বিক উষ্ণতা ‘প্রাক-শিল্প স্তরের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে’ নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে একটি সম্মিলিত এবং সমন্বিত উদ্যোগ। ২০২১ সালে প্রকাশিত চরম আবহাওয়া-সংক্রান্ত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভারত বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। শুধু ২০২২ সালে একাধিক চরম ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ায় আঘাত করেছে। পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যা কমপক্ষে ৩৩ মিলিয়ন মানুষকে প্রভাবিত করেছে এবং কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ বছরের শুরুর দিকে, ব্যাপক বন্যা উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকাকে বাস্তুচ্যুত ও ধ্বংস করেছে। বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনই এর কারণ। এর সুবাদে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত ১৩৪টি উন্নয়নশীল দেশের জোটের সভাপতি দেশ হিসেবে পাকিস্তান ক্ষতিপূরণের বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে। যুদ্ধে উন্নত বিশ্ব কত অর্থ ব্যয় করছে, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার প্রত্যাশা করছে অনেক দেশ। আয়োজক মিসর সতর্ক করে দিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি পেলে সম্মেলনকে ঘিরে আস্থার সংকট তৈরি হবে। কপ ২৭-এ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানা ক্ষয়ক্ষতি ও লস অ্যান্ড ড্যামেজ প্রধান আলোচনার বিষয় হবে। উন্নত দেশগুলো লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করার কথা রয়েছে।
কভিড-১৯-এর ফলে সৃষ্ট চলমান অর্থনৈতিক প্রভাব, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং বিভিন্ন দুর্যোগের আকারে জলবায়ু পরিবর্তনের বাড়তি প্রভাবের ফলে কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমিয়ে আনাসহ আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিষয়টি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ অবস্থায় প্যারিস চুক্তিটি অপ্রাসঙ্গিকতার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। প্যারিস চুক্তিতে সর্ব প্রথম উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষতির কথা গৃহীত হয়। নিঃসরণ হ্রাসের মাধ্যমেই যে এর সমাধান করা সম্ভব, তারও স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ধনী দেশগুলো তখন ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করতে সম্মত হয়েছিল। উন্নত দেশগুলোর সহায়তার প্রতিশ্রুতিটিই এবারের কপ সম্মেলনের কার্যতালিকায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে। ২০০৯ সালে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি প্রশমনে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নত বিশ্ব বছরে ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দেবে। ২০২০ সালে ওই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু প্রায় তিন বছর পর এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। নিরাশ হয়ে এবারের সম্মেলনে যাচ্ছেন না সুইডেনের তরুণ কিন্তু প্রভাবশালী জলবায়ু আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ।
জাতিসংঘ মহাসচিব এবারের সম্মেলনকে উন্নত বিশ্বের জন্য লিটমাস পরীক্ষার সঙ্গে তুলনা করেছেন। ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্ব জলবায়ু ইস্যুতে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করলেও নগদ সহায়তার বিষয়ে তাৎক্ষণিক কিছু জানায়নি। আগামী বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কায় ক্ষতিপূরণ নিয়ে উন্নত বিশ্ব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ইউক্রেনে রুশ সামরিক আগ্রাসনের জেরে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা সমস্যা দেখা দেওয়ায় উন্নত দেশগুলো নিজ নিজ অর্থনীতির দিকেই বেশি দৃষ্টি দিচ্ছে। শীর্ষ দুই দূষণকারী যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো বড় দেশের ভূমিকা সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ হবে, যা আগেও ছিল। কপ ২৭ সফল হয়েছে কি না তা সামনে বোঝা যাবে। আয়োজক দেশ চাইবে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমাতে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্য নির্গমনের জন্য সমস্ত দেশ যেন নতুন করে অঙ্গীকার করে। অন্যদিকে, উন্নয়নশীল দেশগুলো আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ চাইবে। এগুলোতে কোনো সুরাহা না হলে, কপ ২৭-এর সাফল্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, বিশ্বনেতারা জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুত্ব, ভয়াবহতা বুঝতে এরই মধ্যে অনেক দেরি করে ফেলেছেন।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট/raihan567@yahoo.com